Tuesday 25 February 2020

সাদা ডাইনির কুঠি- পর্ব-১ (ভৌতিক গল্প)

সাদা ডাইনির কুঠি- পর্ব-১ (ভৌতিক গল্প)

'কি সুন্দরভাবে মিথ্যে কথাগুলো সাজানো দেখ। আমাদের দেশের নীল আর চা, আমেরিকার তুলো আর তামাক, ক্যারিবিয়ানের চিনি - সাহেবদের এইসব ক্যাশ ক্রপ, যার সাথে কয়েকশো বছরের একটানা জঘন্য অপরাধ আর অমানুষিক অত্যাচারের ইতিহাস জড়ানো। অথচ এই প্ল্যানটেশন হাউস বা কুঠিবাড়িগুলো অসম্ভব চার্মিং, এদের নিয়ে কত গল্প-উপন্যাস, শিল্প, সঙ্গীত। এগুলোই সভ্যতার পিনাকল, রোম্যান্টিক গল্পের পটভূমি, এখানে সিনেমার স্যুটিং হয়, ট্যুরিস্টরা এগুলো দেখতে ভিড় জমায়। এই যেমন আমরা এসেছি। কিন্তু কন্যান ডয়েল সেই যে শার্লক হোমসকে দিয়ে বলিয়েছেন না - এই ম্যানর হাউসগুলো সব রকম অপরাধের তীর্থস্থান' একটানা কথাগুলো বলে সঞ্জয় দম নিতে থামল। সৌম্যা ওর কাঁধে মাথা রেখে হাসছে।

'হয়েছে, আর ভয় দেখাতে হবে না। এটা আরেকটা জালি হানাবাড়ি, স্রেফ ট্যুরিস্ট ঠকানো জায়গা, এর থেকে সমুদ্রে থাকলেই পারতাম।'

এখান থেকে সমুদ্রটা দেখা যায়না কিন্তু হাওয়ার ঝাপটায় সৌম্যার চুল এলোমেলো। নারকেল আর কৃষ্ণচূড়া গাছের ফাঁক দিয়ে পুরোনো কুঠিবাড়িটার রাজকীয় চেহারা দেখা যাচ্ছে, তার সামনে সবুজ ঘাসজমি, আদ্যিকালের পাথরে বাঁধানো রাস্তা, দুপাশে ফুলে ভরা নানারঙের জবা, ফ্ল্যামেনকো, আর বোগানভিলিয়ার ঝোপ। ওদের দলটা এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। ওরা সবাই হিউসটন এলাকার প্রবাসী বাঙালি, দল বেঁধে প্রত্যেক বছরই কোথাও না কোথাও যায়, এবার এসেছে জ্যামাইকাতে। নানা বয়সের পরিবার, তার মধ্যে সঞ্জয় আর সৌম্যা সবচেয়ে ছোটো, ওদের বিয়ের পাঁচ বছরও হয়নি, যদিও বিয়ের আগে কলেজ জীবন থেকেই ওরা একসাথে থেকেছে বেশ কিছুদিন। সঞ্জয় ডাক্তার, হিউস্টনের একটা নামকরা মেডিক্যাল সেন্টারে কাজ করে, ফার্মাসিউটিক্যাল রিসার্চে ওর বেশ নামডাক আছে। ওদের মধ্যমণি সৌমিত্রদা, পঞ্চাশ ছাড়িয়েও চিরযুবক, পেশায় ইমিগ্রেশন ল'ইয়ার কিন্তু রিয়াল এস্টেটের ব্যবসায় অনেক টাকা করেছেন।

হিউস্টনের দেশি মহলে উনি একজন কেউকেটা লোক। শহরে বাঙালির সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান, অর্থাৎ দুর্গাবাড়ি প্রতিষ্ঠায় ভদ্রলোকের মস্ত অবদান আছে, কিন্তু তাই বলে কোনো গ্রামভারী চালিয়াতি ভাব ওঁর স্বভাবে নেই। সবার সঙ্গে হৈ হৈ করতে ভালোবাসেন, একেবারে মাইডিয়ার মাটির মানুষ। ওঁর স্ত্রী অরুণাও খুব পপুলার ছিলেন। প্রায় দেড় বছর আগে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতোই অরুণা হঠাৎ করে হাইওয়েতে একটা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। তারপর নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছিলেন সৌমিত্রদা। গোটা হিউস্টনের বঙ্গসমাজেই একটা শোকের আবহাওয়া নেমে এসেছিল। এবার অনেক বলে কয়ে ওরা সৌমিত্রদাকে আসতে রাজি করিয়েছে কিন্তু এখনও উনি খুব ডিপ্রেসড, সবাই প্রাণপণে ওঁকে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করছে।

'সৌমিত্রদা এই রোজ হলের ইতিহাসটা বেশ গা ছমছমে, নয়? আরেকবার গল্পটা বলুন না।'

ওরা সবাই বাড়িটার গেটের সামনে জমায়েত হয়েছে। সৌমিত্রকে বাদ দিলে তিনটে পরিবার, চন্দন আর এষা, সঞ্জয় আর সৌম্যা, সুপ্রতীক এবং মিলি। একমাত্র মিলিই চাকরি করে না কিন্তু ও সাংঘাতিক কাজের মেয়ে, ওকে ছাড়া এইসব দল বেঁধে হইহুল্লোড়, বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবাই যায়না। কোথায় কি ডিল পাওয়া যায়, কবে প্লেনের টিকিট সস্তা হবে, বাচ্চারা কি করবে, কোন রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া হবে, সবেতেই মিলি আর মিলি। ওকে দেখতেও বেশ নায়িকা নায়িকা, দারুণ রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, মধ্য তিরিশেও ছিপছিপে, কাঁধ অবধি স্টেপকাট কালো চুলের ফ্রেমে ওর ধারালো মুখশ্রী, সেখানে সবসময় হাসির আলো জ্বালা থাকে। হাল্কা আইশ্যাডোর ফাঁকে ওর গাঢ় বাদামি ব্যস্ত চোখদুটো সবসময় চারদিকে নজর রাখছে।

সৌমিত্রদার হাতে ক্যারিবিয়ানের কলোনিয়াল ইতিহাস বইটাও মিলির চোখ এড়ায়নি, তাই এই ফাঁকে ওঁকে দিয়ে একটু কথা বলানোর সুযোগটা ও ছাড়বে না। গল্পের গন্ধ পেয়ে দলটা ঘন হয়ে বসল। আকাশ মেঘলা, দূরে সমুদ্রের উপর সন্ধ্যা নামছে, একটু বাদেই শুরু হবে রোজ হলের বিখ্যাত ঘোস্ট ট্যুর। সৌমিত্রদা বইটা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসলেন।

'ওই তো সঞ্জয় বলছিল না—গন উইথ দা উইণ্ড। সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে এইসব স্বর্গদ্বীপের ইতিহাস কিন্তু শুধু ঘাম আর রক্তে চোবানো। যে ভদ্রলোককে সব বোম্বেটেদের আদিপুরুষ বলা যায় সেই ক্রিস্টোফার কলম্বাস ১৪৯৪ সালে তাঁর দ্বিতীয় সমুদ্রযাত্রায় এখানে নোঙর ফেলেছিলেন। দ্বীপের বাসিন্দা অ্যারাওয়াক উপজাতির লোকেরা (উনি যাদের ইণ্ডিয়ান ঠাউরেছিলেন) ছিল অতি শান্তিপ্রিয় বোকাসোকা টাইপের, তারা বেশ উৎসাহ করেই অতিথিসৎকার করতে এসেছিল। স্প্যানিয়ার্ডরা যখন দেখল যে দ্বীপে সোনাটোনা কোথাও নেই তখন বাধ্য হয়ে ওই লোকগুলোকেই শিকলে বেঁধে জাহাজের খোলে পুরে ফেলল। জাহাজ ভাড়াটা তো তুলতে হবে, তাছাড়া বেচারাদের খ্রীষ্টান করে নরকের হাত থেকে বাঁচানোর দস্তুরি হিসাবে পুণ্যও কিছুটা জমা হয়ে গেল। স্প্যানিয়ার্ডরা অনেকদিন সমুদ্রে থেকে বোর হয়ে গেছিল কিনা, নেটিভদের নিয়ে নানারকম খেলা করে ওরা বেশ আমোদ পেত।

যেমন কিনা মেয়েগুলোকে পাইকারিভাবে বিছানায় তোলা আর ছেলেগুলোর হাত-পা কেটে তরোয়ালের ধার পরীক্ষা করা। সে যাক কিছু দো-আঁশলা বাদ দিয়ে গোটা জাতিটাই প্রায় একশ বছরের মধ্যে মরে ফর্সা হয়ে গেল, সেই জায়গাটা দখল করল হেনরি মর্গ্যানের মতো জলদস্যুরা আর আফ্রিকা থেকে আমদানি করা নিগ্রো ক্রীতদাসের দল। এর মধ্যে ইংরেজরা এসে স্প্যানিশদের হটিয়ে দিয়েছে, তারা ব্যবসাদার লোক, জ্যামাইকার মাটিতে যে অন্যরকম সোনা ফলতে পারে তার খবর পেতেও তাদের দেরি হল না। ১৭১৬ থেকে ১৮৩৪ অবধি জ্যামাইকা হয়ে উঠল দাসব্যবসার একচেটিয়া ঘাঁটি। হাজার হাজার আফ্রিকানকে জাহাজ বোঝাই করে আখের ক্ষেতে চালান করা হতে থাকল।

তখন সারা ক্যারিবিয়ান আর দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে রমরমিয়ে এইসব ক্যাশ ক্রপের ব্যবসা চলছে—চিনি, তুলো, কফি, তামাক। মানুষ খাটিয়ে লাভ সবচেয়ে বেশি শুধু জন্তুজানোয়ারের থেকে সহ্যক্ষমতা কম বলে মানুষগুলো একটু তাড়াতাড়ি মারা যায় এই যা। জাহাজের খোলে বমি করতে করতেও মরে বেশ কতগুলো। প্রথমদিকে এইসব খুচরো অসুবিধা কেউ গায়ে মাখেনি। শ'খানেক বছর পরে কিছু কিছু ঝামেলা দেখা দিল বটে। এই যে প্ল্যানটেশনটা দেখছিস এইরকম হাজার হাজার একরের সম্পত্তিগুলোয় মালিক আর দাসের অনুপাত দাঁড়িয়ে গেল ১:৪০। গণসংস্কৃতির প্রবাহ এমনই জিনিস যে চাবুক, শিকল, ধর্ষণ, ধর্মান্তর কিছুই তার চোরাস্রোত আটকাতে পারেনা। তাই হাইতি থেকে লুইসিয়ানা অবধি শিকড় ছড়িয়ে দিল এক অদ্ভুত ভাষা ও সংস্কৃতি -- ক্রিওল। অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলোর মতো গড়ে উঠলো গান আর নাচের ছন্দ, ধর্ম আর মিথোলজি। আমাদের দেশের প্রান্তিক জনজাতিগুলোর মতন প্রকৃতির সঙ্গে আষ্টেপিষ্টে জড়ানো এই সংস্কৃতির কেন্দ্রে আছে ভুডু প্র্যাকটিস। কালোজাদু বদনাম নিয়ে ভুডু অনেক লোম খাড়া করা গল্পের বিষয় হয়েছে বটে কিন্তু আর পাঁচটা পুরোনো ধর্মের সঙ্গে ওর খুব একটা পার্থক্য নেই। সে যাক এই রোজ হলের গপ্পোটা যাকে বলে সাংঘাতিক--বিকৃতকামা নারী, মারণ-উচাটন, অকথ্য অত্যাচার আর ধারাবাহিক খুব সব একসাথে পাঞ্চ করা। তাইজন্য না দুনিয়ার লোক এই সাদা ডাইনির কুঠিতে ভুতুড়ে সন্ধ্যা কাটাতে আসে। অবশ্য এখানে যা দেখবে পুরোটাই অভিনয়।'

শেয়ার করুন

0 Please Share a Your Opinion.: