Saturday 29 February 2020

সাদা ডাইনির কুঠি- (পর্ব -৫) ভৌতিক গল্প

সাদা ডাইনির কুঠি- (পর্ব -৫)


'আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?'

'কি নিয়ে বলুন তো।' মেয়েটি একটু অবাক কিন্তু বিরক্ত নয়।

'মিঃ বোসের কেবিনে আপনার সাথে কয়েকবার কথা হয়েছে। আমরা সবাই ওঁর বন্ধু, ওনাকে নিয়েই দু একটা প্রশ্ন ছিল, যদি কিছু না মনে করেন।'

'কিচ্ছু মনে করব না' মেয়েটি রহস্যময় হাসি হাসল, 'ভাবছিলাম কবে আপনাদের সঙ্গে ঠিক করে আলাপ হবে। আমি কে তাই নিয়ে নিশ্চয়ই অনেক প্রশ্ন জমেছে আপনাদের মনে তাই না।'

'এই তো হয়ে গেল, চলুন না এক কাপ কফি নিয়ে বসা যাক।' স্টারবাকসের দোকানটায় বেশ ভিড়, ওরা একটু তফাতে গিয়ে বসল।

'আমার নাম প্রীতি সিন্‌হা, আমার ঠিক পরিচয়টা আপনাদের আগে দিইনি, সেজন্য মাপ চাইছি। আসলে আমি আর সৌমিত্র বিবাহিত। নিউইয়র্কে অল্পদিন আগে আমাদের প্রথম দেখা তার আগে পরিচয় ছিল ফেসবুকে। আমাদের দুজনের জীবনই নানাদিক দিয়ে এলোমেলো ছিল কিন্তু কেন জানিনা আমরা পরস্পরকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম। আমরা বিয়ে করলাম আপনাদের ওই অভিশপ্ত বেড়াতে যাওয়ার ঠিক এক হপ্তা আগে। এই নিয়ে কি মারাত্মক সামাজিক ঝড় উঠতে পারে সেটা জেনেই আমরা সবকিছু গোপন রাখি। কথা ছিল জ্যামাইকায় হবে আমাদের গোপন হনিমুন, ফেরার আগে ও আপনাদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেবে। ও বলেছিল আপনারা খুব ভালো বন্ধু, উদারমনস্ক আধুনিক লোক, আপনারা আমাদের কথাটাও শুনবেন, একপেশে বিচার করবেন না। তার আগেই তো এই সর্বনাশ কাণ্ড, সব প্ল্যান খতম। আসলে আমি মেয়েটাই অপয়া, দিস ইজ আ কারস্‌ড রিলেশনশিপ, সবারই জীবন ছারখার হয়ে গেল। এখনো এইসব কাগজপত্র আছে, আপনারা এগুলো নিয়ে আমাকে মুক্তি দিন। ওর ছেলের সামনে দাঁড়াবার সাহস আমার নেই, আপনারা আমার হয়ে ওর পরিবারের কাছে মাপ চেয়ে নেবেন। আমি কারো ক্ষতি করতে চাইনি।'

'আপনি জ্যামাইকাতে গেছিলেন' মিলি কোনোরকমে উচ্চারণ করল। বাকি সকলের চোয়াল ঝুলে পড়েছে, কথা বলার শক্তি নেই। অবাক হওয়ার সীমায় পৌঁছে গেছে সবাই।

'গিয়েছিলাম কি ভেবে আর কি হয়ে গেল।' প্রীতি কান্না সামলাতে সামলাতে ব্যাগ খুলে একটা সুদৃশ্য খাম বার করেছে--তার উপর লেখা 'লাস্ট উইল অ্যাণ্ড টেস্টামেন্ট অফ সৌমিত্র বোস।'

'এখানে স্ত্রী হিসাবে অরুণাদির জায়গায় আমার নামটা লিখে নোটারাইজ করা আছে। কিন্তু আমি এটা রাখতে চাইনা। আমি ভালো কোম্পানিতে কাজ করি টাকাপয়সার কোনো দরকার আমার নেই। আমার বাবা নেই, মা ডিভোর্সি, ইংল্যাণ্ডে থাকে। যে অসমবয়স্ক মানুষটার কাছে স্নেহ আর প্রেম দুইই পেয়েছিলাম, যার জন্য পুরো সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেও পেছপা হতাম না, সে তো এখন একটা কাটা গাছের গুঁড়ির মতো অসহায়। যদি ও বেঁচে ওঠে তবে আবার এসে ভাঙা টুকরোগুলোকে জোড়া দেবার চেষ্টা করব। যদি না বাঁচে আমার কপালের দোষ কিন্তু সেক্ষেত্রে এই উইলটার কোনো দাম নেই আমার কাছে। জীবনে অনেক পুরুষমানুষের সাথে থেকেছি, বারণ করবার কেউ ছিলনা। সৌমিত্রর মতন এমন সহ্যশীল, স্নেহপ্রবণ অথচ ভালোবাসার কাঙাল আমি আর কোথাও পাব না। অরুণাদির সঙ্গে ওর কোনো মিল ছিল না জানেন, মানসিকভাবে ওরা দুই মেরুর বাসিন্দা। অসম্ভব ডিপ্রেসড ছিল কিন্তু কাউকে বুঝতে দিত না। সমাজ আর সন্তানের মুখ চেয়ে এতবছর ও একটা সম্পর্কের মৃতদেহ বয়ে বেড়িয়েছে। শুধু আমার কাছে ও সেই বোঝা নামিয়েছিল। কিন্তু কি হয়ে গেল দেখুন। জ্যামাইকাতে সেই ভয়ঙ্কর দিনটায় আপনাদের দলের সেই মেয়েটি, এষা না কি যেন নাম, কি কুৎসিতভাবে আমাকে গালিগালাজ করে গেল, আমি নাকি টাকার জন্য ওর সাথে শুয়েছি। ও আমাকে চিনলো কি করে জানি না, আমার ধারণা ছিল সৌমিত্র কাউকে বলেনি। আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম খুব রাগও হয়েছিল, ভেবেছিলাম এক্ষুনি গিয়ে সৌমিত্রর কাছে কৈফিয়ৎ চাইব। ফোন করে জানলাম আপনারা রোজ হলে ঘোস্ট ট্যুর নিতে যাচ্ছেন। ওখানে গিয়ে দেখি এষা আর এক ভদ্রলোক, ওর স্বামীই মনে হল, বাড়িটার সামনে একটা বেঞ্চে বসে বাংলায় কথা বলছে। কথা না বলে ঝগড়া বলাই ভালো। আমাকে দেখে এষা হঠাৎ উঠে বাড়িটার ভেতরে চলে গেল। ভদ্রলোক সোজা উঠে এসে আমায় চার্জ করলেন। আমি কে, সৌমিত্রদার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক, আমার মতলব আসলে কি, এইসব প্রশ্ন। তারপরেই শুনি একটা ধপ করে শব্দ আর এষার চিৎকার। আপনারা সকলে দৌড়ে এলেন, শো বন্ধ হয়ে গেল। ভয়ে আমার মাথা ঘুরতে লাগল, কি করব ভেবে পেলাম না। হঠাৎ মনে হল এখান থেকে পালাই। পরে পুলিশকে সব বলেছি, আমার গাড়ির ড্রাইভার ওখানে ছিল, সেও সাক্ষী আছে। আপনারা আর কি জানতে চান বলুন। আমার লুকোবার কিছুই নেই।'

প্রীতির চোখ দিয়ে তখনো টপটপ করে জল পড়ছে। মিলি এবার ওর হাতটা ধরল।

'আর কিছু প্রশ্ন নেই আপনি যা যা খবর দিলেন তাই হজম করতে আমাদের খানিকটা সময় লাগবে। আপনি শান্ত হোন, আমাদের বন্ধু বলে মনে করুন। এই নিন আমার ফোন নাম্বার, দরকার হলেই ফোন করবেন। আর ওই উইলটা আপনার কাছেই আপাতত থাক।'

সঞ্জয় কি একটা বলতে গেছিল কিন্তু তার আগেই মিলি উঠে পড়েছে।

'কেমন আছ সবাই?' এষার ফোন।

'ভালো। তুই কেমন আছিস সেইটা আগে বল।'

'নতুন জায়গা কাউকে চিনিনা, তাই একা একা লাগে। চাকরিটাও তো ছেড়ে দিলাম। অবশ্য এই বোধহয় ভালো মিলিদি। ভাঙা জিনিস জোড়া লাগাতে হলে সময় তো দিতেই হবে তাই না?'

'চন্দন ঠিক আছে? তোর ওপর কোনোরকম চাপ নেই তো' মিলি একটু চিন্তিত।

যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক ভালো আছে মিলিদি। একটু একটু করে অনেক কথা বলে এখন। উই আর ট্রাইং মিলিদি।'

'ভালো থাকিস রে তোরা। সময় সব কিছু সারিয়ে দেয়।'

'সৌমিত্রদা কেমন আছে' এষার গলাটা ধরা শোনাল।

'খুব একটা ভালো নেই রে। সঞ্জয় তো তাই বলল।'

'সেদিন ওই কথাগুলো না জানলে আমি হয়তো সৌমিত্রদাকে ওভাবে—যাকগে আবার পুরোনো কথা ঘাঁটছি। আমি আসি মিলিদি। চন্দন জানতে পারলে রাগ করবে।'

'কার কাছ থেকে কি শুনেছিলি তুই?'

'পরে বলব মিলিদি। আমি জানতাম না সৌমিত্রদা বিয়ে করেছে। সেদিন সঞ্জয়ের কাছে ওই মেয়েটার কথা শুনে মাথাটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু আমরা তো ঠিকই করেছিলাম যে যার জীবনটা নিয়ে থাকব।'

'তুই আর নিজেকে দোষ দিস না। ভালো থাকিস, আমি আবার ফোন করব।'

ফোনটা কেটে দিয়েই আবার ডায়াল করল মিলি।

'একটা কথা জিজ্ঞেস করব প্রীতি। সত্যি জবাব দেবে?'

'দেবো মিলিদি। তোমার ওপর একটা ভরসা এসে গেছে আমার। প্রতিদিন ফোন করে আমাকে কতখানি যে সাপোর্ট দিয়েছ তুমি, জাননা। না হলে আমিও হয়তো সৌমিত্রের মতো—'

'আবার আজেবাজে কথা।' চোখ পাকিয়ে ছদ্ম বকুনি দিল মিলি, 'তুমি অরুণাদিকে চিনতে? তোমাদের ব্যাপারটা অরুণাদি জানতেন কি?'

'আমি ব্যক্তিগতভাবে ওঁকে চিনতাম না তবে আমার কথা উনি জানতেন। আসলে আমাদের ফেসবুকের বন্ধুত্বটা ওঁর কাছে ধরা পড়ে গেছিল। তাই নিয়ে সাংঘাতিক অশান্তি থেকে মারামারি অবধি। তোমরা জানতে না উনি কি রকম প্যারানয়েড আর কন্ট্রোলিং মহিলা ছিলেন। সত্যি বলতে কি উনিই আমাদের সম্পর্কটাকে পরিণতির দিকে এগিয়ে দেন। মাপ করো মিলিদি, মৃত মানুষের নামে আমার নিন্দা করা উচিত নয়।'

'ঠিক আছে ওইটাই জানার ছিল। আমি আবার কালকে ফোন করব কেমন।' ফোন ছেড়ে দিল মিলি।

'সৌম্যা'।

'বল মিলিদি'।

'সঞ্জয় অ্যাক্সিডেন্টের দিন সকালে তোকে এষা আর সৌমিত্রদার ব্যাপারটা নিয়ে কিছু বলেছিল?'

'না তো। ও সকাল থেকে সুইমিং পুলে ছিল। আমি বাবা ঘুমোচ্ছিলাম।'
'হুঁ। তাহলে এষাকে সেদিন ওইসব কথা বলল কে? প্রীতির ব্যাপারটা তো ও জানতে পেরেছিল। তাই ওরকম আপসেট ছিল সেদিন।'
'আমি তো কিছুই জানি না মিলিদি'।
'ঠিক আছে, আমি পরে ফোন করব। ভালো থাকিস।'
সুপ্রতীক ঘরে এসে দেখে মিলি একগাদা কাগজ নিয়ে খুব মন দিয়ে আঁকিবুকি কাটছে।
প্রথম কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির একটা অদ্ভুত গন্ধ আছে, সেটা দুনিয়ার সব জায়গায় এক। হাসপাতালের সামনে গাড়ি পার্ক করতে করতে সেই গন্ধটা টের পেল মিলি। ভোর হবার সময় হল কিন্তু কারপার্কে এখনো মেঘলা অন্ধকার। সৌমিত্রদার অবস্থা খুব খারাপ, এক্ষুনি সঞ্জয়ের ফোন এল।
'মিলি তুমি সত্যিই এটা করতে চাও? আমরা কিন্তু অন্যভাবেও অ্যাপ্রোচ করতে পারি।' সুপ্রতীক ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
'হ্যাঁ গো। উই ও দিস টু সৌমিত্রদা। তুমি শুধু আমার কাছাকাছি থেক।' মিলির মুখটা থমথমে। সৌমিত্রদা শান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন, সবরকম যন্ত্রপাতি খুলে নেবার ফলে ওঁকে আবার আগের মতোই হ্যাণ্ডসাম দেখাচ্ছে।
'এসো মিলিদি। সব শেষ হয়ে গেল, আমি সবাইকে ফোন করছি।' সঞ্জয়ের গলাটা ধরা শোনালো। ওরা পাশের ঘরে গিয়ে বসেছে এবার।
'সুপ্রতীকদা আসেনি?'
'ও একটু পরে আসবে, কাছাকাছিই আছে। কখন হল?'
'দুটো নাগাদ। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। একদিক থেকে হয়তো ভালোই হল, পঙ্গু, অসহায় সবার করুণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকতে হত, তাও আবার ওই মহিলার খপ্পরে।'
'কোন মহিলার কথা বলছিস'।
'ওই যে সেদিন ন্যাকামি করে কেঁদে ভাসিয়ে দিল। জেনে রেখো, ঐ প্রীতি সিন্‌হাই এই অ্যাক্সিডেন্টের জন্য দায়ী। ও নির্ঘাৎ সেদিন ওই বাড়িতে ঢুকে সৌমিত্রদাকে চার্জ করেছিল। সি প্রোভোকড হিম টু কমিট সুইসাইড। আমি তো ভাবছি পুলিশকে কথাটা জানাব। ওই মহিলা সৌমিত্রদার সম্পত্তির মালিক হবে এটা ভাবলেই আমার রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে। তুমিও তো আবার সোহাগ দেখিয়ে উইলটা ফেরৎ দিয়ে দিলে। আমি বলছি, ওটা আমাদের কাছে থাকার দরকার ছিল।' সঞ্জয় রাগে চেয়ার ছেড়ে উঠে পায়চারি করতে শুরু করেছে।
'দাঁড়া দাঁড়া আগে একটা কথা বল দেখি? এষাকে ফোন করেছিলাম, ও যে বলল তুই প্রীতির ব্যাপারটা আগে থেকেই জানতিস। জ্যামাইকায় সেদিন সকালবেলা তুই নাকি এষাকে সৌমিত্রদার গোপন বিয়ের খবর সব বেশ ফলাও করে বলেছিলি। সত্যি নাকি রে?'
সঞ্জয় থমকে গেল। উত্তর দিতে প্রায় তিরিশ সেকেণ্ড দেরি হল ওর। 'না না জানতাম না, ওই গুজব শুনেছিলাম আর কি। তুমি আবার এ নিয়ে এষার সাথে কথা বলেছো। মেয়েটার এমনিতেই মাথার ঠিক নেই।'
'হ্যাঁ বেচারা খালি নিজেকে দোষী ভাবছে। সৌমিত্রদা ওর মনে দুঃখ দিয়েছিলেন বটে। ওকে ঘর ভাঙতে বারণ করেছিলেন, চন্দনের সঙ্গে সম্পর্কটা আবার করে শুরু করতে বলেছিলেন। প্রীতি নয়, সেদিন এষার সাথে কথা বলতে বলতেই তো সৌমিত্রদা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তবে সে অসুখের জন্য এষা বোধহয় দায়ী নয়। ও বেচারা তো এক গ্লাস জল আনতে ছুটে গিয়েছিল।'
'সাতসকালে কি সব গল্প বানাচ্ছ মিলিদি? তুমি তো নেশা টেশা করতে না।' সঞ্জয়ের গলাটা রুক্ষ শোনাল, 'ফোন-টোন গুলো করতে হবে না কি?'
'আরে ফোন করার সময় তো পড়েই আছে, শোন না। আমার কিন্তু একটা নালিশ আছে। তুই আর সৌমিত্রদা যে পার্টনার, একসঙ্গে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করছিলি, এটা তো বলিসনি। জানলে আমিও নেমে পড়তাম। অবশ্য এই রিশেশনের বাজারে রিয়েল এস্টেটের যা অবস্থা। শুনলাম ২০০৮ সালের হাউসিং বাবলটা ফাটার সময় তোর নাকি সৌমিত্রদার কাছে অনেক টাকা ধার হয়ে গেছিল--এই ধর কয়েক মিলিয়ন, তাই না! প্রীতি যে বলল, সৌমিত্রদার কাছ থেকেই শুনেছে।'
'আউট্রেজিয়াস। তুমি কি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছ মিলিদি! মতলবটা কি তোমার?'
'আরে না না আগে তো সবটা শোন। সুপ্রতীকের অনেক গলফ খেলার বন্ধু আছে জানিস তো। তার মধ্যে একজন তোদের ডিপার্টমেন্টের ডাক্তার, রিচ গোলডম্যান না কি যেন নাম। বলল তুই নাকি কি একটা রিসার্চ প্রজেক্ট নিয়ে ঝামেলায় পড়েছিস, এনকোয়ারি হবে, সাসপেনশনও হতে পারে। কি একটা নতুন ওষুধ যেটা নাকি একটু বেশি ডোজে নিলে রক্তচাপ হু হু করে বেড়ে যায়, পেশেন্টের স্ট্রোক বা হার্ট-অ্যাটাক অবধারিত।'
সঞ্জয়ের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চাপা দাঁতের ফাঁক দিয়ে হিসহিস করে কথাগুলো বেরুল, 'আমাকে ফাঁসাতে চাইছ তাই না? ডিটেকটিভ হয়েছ? সৌমিত্রদার সাথে শোবার ইচ্ছা তোমারও ছিল বুঝি? নাহলে ওর জন্য এত দরদ কিসের? লোকটা আমার টাকা নিয়ে ব্যবসা করে আমাকেই ডুবিয়েছে কিন্তু নিজে ঠিক পিছলে গেছে। কিন্তু তার সঙ্গে এই ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। আর আমার রিসার্চের ব্যাপারে আমি তোমার কাছে কৈফিয়ৎ দেব না। তোমাদের সব ছেনালিপনা আমার জানা আছে।'
'এই তো আসল চেহারাটা দেখা যাচ্ছে। ডঃ সঞ্জয় মজুমদার, ওই ওষুধটার নাম ক্রিবোস্ট্যাটিন তাই না? ওটার ওপর তোমার অনেক আশা ছিল কিন্তু ওই বিপজ্জনক টক্সিসিটির জন্য পুরো প্রজেক্টটাই সোজাসুজি বাতিল হয়ে যেত। মরিয়া হয়ে তুমি ডাটাগুলোকে এদিকওদিক করে, নানাভাবে জোচ্চুরি করে রিপোর্ট দাখিল করলে যাতে তোমার গ্রান্ট বজায় থাকে, প্রমোশনটাও হয়ে যায়। কিন্তু এদিকে তোমাদের রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা ডকে উঠেছে, সৌমিত্রদার সে ক্ষতি সহ্য করার ক্ষমতা থাকলেও তোমার নেই। ওদিকে তোমার জুয়াচুরিও ধরা পড়ে গেছে, চাকরি থাকবে কিনা সন্দেহ।'
'মিথ্যে কথা, সব মিথ্যে কথা' সঞ্জয় বিড়বিড় করে বলল। সৌমিত্র আগে থেকে টের পেয়ে নিজের পয়সা সরিয়ে ফেলেছিল।'
'তুমি আমাদের সাহায্য চাইতে পারতে কিন্তু তোমার অহংকারে বাধল। তুমি অপরাধের পথে আরো খানিকটা নেমে যাওয়াই ঠিক করলে। অরুণাদির কাছে তুমি প্রীতির কথা জানতে পার। সৌম্যার সন্দেহ ছিল এষার সাথে সৌমিত্রদার কিছু একটা আছে, তুমিও তার আঁচ পেয়েছিলে। সৌমিত্রদা প্রীতির সঙ্গে বিয়ের পরেই টাকাটা ফেরত চেয়েছিলেন। তুমি ভাবলে ক্রিবোস্ট্যাটিনের এই মারাত্মক সাইড এফেক্টটাকে কাজে লাগালে কেমন হয়। তাই ল্যাবের স্টক থেকে ওষুধ সরিয়ে নিজের কাছে রেখেছিলে, অডিটে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। জ্যামাইকার ট্রিপটা ছিল তোমার একটা বড় সুযোগ। ক্যারিবিয়ানের অপরিচিত পরিবেশে ক্রাইমটাকে লুকিয়ে রাখা যায় একটা অস্পষ্টতার চাদরে — ভূতের বাড়ি, হিস্টেরিয়াগ্রস্থ নারী আর ত্রিকোণ প্রেমের কেচ্ছায় জড়ানো পারফেক্ট মার্ডার। অরুণাদি নেই, একমাত্র ছেলে দূরে থাকে, কাগজপত্র কোথায় কি আছে কে জানে, তারপরে এইসব কেলেঙ্কারি। এসবের মধ্যে ধার শোধের ব্যাপারটা ধামা চাপা পড়ে যেত তাই না?'
'ইউ আর টু স্মার্ট টু লিভ মিলিদি।' সঞ্জয়ের মুখে বিকট হাসি। ও পায়ে পায়ে মিলির কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। এইবার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিতে গেল। কিন্তু তার আগেই এক ঝটকায় দরজা খুলে সুপ্রতীক ঘরে ঢুকে পড়েছে।
'এই যে ডাক্তারবাবু আরেকটা খুন করার চেষ্টায় আছো নাকি? সেদিন টুক করে সৌমিত্রদার রামে ওষুধ মিশিয়ে দিলে কিন্তু কপাল খারাপ। লোকটা কোথায় ঐসব ভুতুড়ে চেঁচামেচির সময় হার্ট অ্যাটাক হয়ে অক্কা পাবে, তার বদলে বমি করতে করতে ব্যালান্স হারিয়ে বারান্দা থেকে উলটে পড়ে গেল। অ্যানি পামার মাথায় পাঁচ ফুটের কম ছিল, যাতে ওর অসুবিধা না হয় সেইজন্য ব্যালকনির রেলিংগুলো খাটো করে দেওয়া হয়েছিল কিনা। তা সৌমিত্রদার কঠিন প্রাণ বটে, টিঁকে রইল এতদিন, ভালোও হয়ে উঠছিল একটু একটু। বাধ্য হয়ে আজ সন্ধ্যায় সেকেণ্ড ডোজটা দিতে হল তাই না? প্লীজ কাম ইন ইনস্পেক্টার আপনি তো এতক্ষণ ধরে সব কথাই শুনলেন। হিউস্টন পুলিশ তো কেসটা এখনো বন্ধ করেনি।'

শেয়ার করুন

1 comment: