Thursday 27 February 2020

সাদা ডাইনির কুঠি (পর্ব-৩) ভৌতিক গল্প


সাদা ডাইনির কুঠি (পর্ব-৩) ভৌতিক গল্প

'আসলে অরুণাদির মারা যাবার পরে সৌমিত্রদা এমন ভেঙে পড়েছিলেন যে ওই নিয়ে কথা তুলতে সবারই রুচিতে বেধেছিল। এখন মনে হচ্ছে সৌমিত্রদা হঠাৎ আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন কেন? ঐ বাড়িতেই কেন ব্যাপারটা হল? এষা বলছিল—'

'থাক থাক। এষার মতে সৌমিত্রদাকে ভূতে ঠেলে ফেলে দিয়েছে তাইতো? রিডিকুলাস'

'আমি কি তাই বললাম? আচ্ছা, তুমি সঞ্জয়ের সঙ্গে কথা বলে দেখ। অরুণাদির মেডিক্যাল রিপোর্টে কিসব গণ্ডগোল ছিল।'

'দেখ আমার ধারণা সৌমিত্রদা ডিপ্রেসড ছিলেন। সেদিন বিকেল থেকে মদ খাচ্ছিলেন। ওই বাড়ির মর্বিড পরিবেশ আর অ্যালকোহল সব মিলিয়ে ওঁর মাথায় আত্মহত্যার ঝোঁক চাপে।' মিলি কথাটা শেষ করে দিল বটে কিন্তু অস্বস্তিটা রয়েই গেল। জ্যামাইকার পুলিশ কেসটা বন্ধ করে দিয়েছে। এখানকার পুলিশ কি করছে ও জানে না কিন্তু সঞ্জয় বলছিল কোনো অপরাধ বা ফাউল-প্লে সন্দেহ করা হচ্ছে না, অ্যাটেম্পটেড সুইসাইড বলেই মনে হয়। তবুও একই পরিবারে এরকম পরপর দু-দুটো দুর্ঘটনা হলে প্রশ্ন তো উঠবেই। মিলি এক বছর আগের ঘটনাগুলো মনে মনে সাজাবার চেষ্টা করল, বিশেষ করে একটা সন্ধ্যাবেলার কথা। নিউইয়ার্স ইভ, সৌমিত্রদার বিশাল বাড়িতে খুব জোর পার্টি জমেছে। বারোটার পরে সবাই যখন কিছুটা বেসামাল, এষা সৌমিত্রদার সঙ্গে বেশ একটু ফ্লার্ট করছিল বটে। সবাই হাসছিল কিন্তু অরুণাদিকে ও দেখেছিল মুখ কালো করে এক কোণায় আড়ষ্ট হয়ে বসে আছেন। এষা একটু ন্যাকামি করে বটে কিন্তু ওর মনটা খুব ভালো আর এরকম বড় পার্টির মধ্যে এসব একটু আধটু তো হয়েই থাকে। অ্যাক্সিডেন্টের দিন অরুণাদি নাকি ড্রাঙ্ক ড্রাইভিং করছিল, যেটা একটু অস্বস্তিকর হলেও অসম্ভব কোনোমতেই নয়, ও নিজেই তো কতবার টিপসি হয়ে ফিরেছে। এসব আবোলতাবোল কথা ভাবতে ভাবতেই ও হাসপাতাল পৌঁছে গেল।

'সঞ্জয়, কেমন আছে রে সৌমিত্রদা আজকে?'

'ওই একই রকম মিলিদি। হাত পা ভাঙা, লাংস আর কিডনিতে ফুটো, ওসব বেশ তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠছে কিন্তু মাথা আর ঘাড়ের ইনজুরিটাই সমস্যা। জ্ঞান ফিরলেও কোয়াড্রিপ্লেজিয়া মানে পুরো শরীরটাই অসাড় আর দুর্বল হয়ে যেতে পারে। কিছুদিন না কাটলে বোঝা যাবে না।'

'সঞ্জয় তোর সাথে কথা আছে। চল কাফেতে গিয়ে বসি। আচ্ছা অরুণাদির অ্যাক্সিডেন্ট নিয়ে তুই ঠিক কি কি জানিস বলতো? তোর হাসপাতালেই তো নিয়ে এসেছিল।'

'মিলিদি এসব কনফিডেনসিয়াল কিন্তু তোমাকে এটুকু বলতে পারি যে অরুণাদির রক্তে শুধু অ্যালকোহলই ছিল না, নারকোটিকও ছিল। অথচ ওঁর ওইরকম কোনো প্রেসক্রিপশন ছিল না।'

'অরুণাদি নেশা করত এটা বিশ্বাস করা মুশকিল। আচ্ছা ওদের মধ্যে কোনো ঝগড়া হয়েছিল কিনা শুনেছিস।'

'তুমি যা যা শুনেছো আমিও তাই শুনেছি। বাঙালি তিলকে তাল করে। কিন্তু কয়েকটা ব্যাপার খটকা লাগারই মতো। হাসপাতালে আমরা ছাড়া একটি অল্পবয়সী মেয়ে দু-একবার এসেছিল ওঁকে দেখতে। ভারতীয়, বোধহয় বাঙালি, প্রীতি সিন্‌হা না কি যেন একটা নাম, কিন্তু অ্যাকসেন্ট শুনে মনে হয় সেকেণ্ড জেনারেশন। আমরা কেউ ওকে চিনিনা। লোকের কিউরিওসিটির তো অভাব নেই, আর সৌমিত্রদাও নির্বাক, তাই অবাধে গুজব ছড়াচ্ছে। কেন জানিনা চন্দন ওঁর উপর খাপ্পা, অথচ জ্যামাইকায় যাবার আগে তো কিছু বুঝিনি। কে জানে বাবা—'

'এষাই তো ওকে পড়ে যেতে দেখেছে তাই না?'

'হ্যাঁ, তারপর থেকে ও কেমন একটা নার্ভাস ব্রেকডাউনে ভুগছে। হয়তো সেইজন্যই চন্দনের রাগ।'

'আজ সন্ধ্যায় ওদেরও ডেকেছি, কথা বলে দেখবো তখন। সৌম্যাকে বলিস তাড়াতাড়ি চলে আসতে।'

'সৌম্যা একটা কথা জিগ্যেস করছিল। এষা আর চন্দন বাসের কাছে ছিল, বাড়ির ভেতর ঢোকেনি তাইনা। অথচ সৌমিত্রদার পড়ে যাওয়াটা এষা দেখেছে বাড়িটার ব্যাকইয়ার্ডে, যেখানে স্লেভ কোয়ার্টারগুলো ছিল, সেখান থেকে। ওই দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অ্যানি নাকি ওভারসিয়ারদের চাবুক মারা দেখত আর খিলখিল করে হাসত। তোমার মনে আছে মিলিদি আমরা যখন কবরখানার দিক থেকে দৌড়ে এলাম, চন্দন ওখানে ছিল না, ও আমাদের সঙ্গেই দৌড়ে এল কিন্তু বাড়ির ভিতর থেকে। এষার মতো ভিতু মেয়ে একলা স্লেভ কোয়ার্টারের দিকে গেছিল কেন?'
'হুঁ। ওই প্যানিকের মধ্যে আমি খেয়াল করিনি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সৌম্যা ঠিকই বলেছে। দাঁড়া দাঁড়া, চন্দনের হাতে একটা ড্রিঙ্ক ছিল না। বারে গেছিল নাকি?'

'এষাকে একলা রেখে? একটু আনলাইক চন্দন, তাই না। ও যেমন পসেসিভ ছেলে।'

'তুই কি বলতে চাইছিস?'

'কিছু না। সৌম্যা বলছিল চন্দন সেই থেকে কেমন যেন অস্বাভাবিক ব্যবহার করছে।'

মিলি সৌমিত্রের ঘরে ঢুকল। গলার মধ্যে টিউব ঢোকানো, সৌমিত্রদা চোখ খুলছেন মাঝে মাঝে, কিন্তু কথা বলার প্রশ্নই আসে না। লম্বা, সুপুরুষ লোকটাকে কি অসহায় লাগছে। চারদিকে যন্ত্রপাতি, মনিটরের স্ক্রীনে নানারকম আঁকিবুকি আর সংখ্যা, সব মিলিয়ে একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্ন। মিলি ঠিক করল আজ রাত্তিরে সবার সাথে পুরো ঘটনাটা রিভিউ করবে, যত অস্বস্তিই তাতে হোক না কেন।

শনিবার সন্ধ্যাবেলাটা ওদের সারা সপ্তাহে সবচেয়ে আরামের সময়। খেজুরে আড্ডা, হইচই, মদ্যপান আর দেশি সিনেমা দেখে সময়টা কাটে, মাঝে মাঝে পলিটিকস বা সাহিত্য আলোচনাও জমে বেশ। আজকে মুড আলাদা, ওরা বাচ্চাদের বেসমেন্টে পাঠিয়ে দিয়ে, বড় টেবিলটার চারিদিকে গোল হয়ে বসেছে, সকলের মুখ গম্ভীর। মিলিই কথা শুরু করল।
'আমরা সবাই অনেকদিনের বন্ধু, প্রবাসে আত্মীয়স্বজন বলতেও আমরাই। এরকম একটা দুর্ঘটনার পরে আমাদের মধ্যে কিছু কিছু প্রশ্ন বা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হতেই পারে। তাছাড়া আমাদের আরো বন্ধুবান্ধব আছে, সৌমিত্রদার কথা তো বলাই বাহুল্য, আমাদের হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে রোজ। এতদিন আমরাও একটা শকের মধ্যে ছিলাম। এখন মাথা ঠাণ্ডা করে সেদিনের ঘটনাগুলোর দিকে আরেকবার ফিরে দেখা দরকার। আমরা যদি আলাদা আলাদা গপ্পো বলতে শুরু করি তাহলে বাজে গসিপ আর স্পেকুলেশন ছড়াবে। এ নিয়ে লিগাল ঝামেলাও শুরু হতে পারে, আমাদের রেডি থাকা উচিত।'

'দাঁড়াও দাঁড়াও' চন্দন রুক্ষ গলায় বলল, 'মিলিদি তুমি কি বলতে চাইছ? আমরা গুজব ছড়াচ্ছি, না আমাদের নিয়েই গুজব ছড়ানো হচ্ছে? সত্যি কথাটা হল এই যে সৌমিত্রদাকে চিনতে আমরা ভুল করেছিলাম। ভদ্রলোকের এই অবস্থার জন্য উনি নিজেই দায়ী, হি ওয়াজ লিভিং আ ডবল লাইফ। এদিকে শিক্ষিত, অমায়িক, বাংলা সংস্কৃতির ধারক, অন্যদিকে পাক্কা ওম্যানাইজার, সংস্কৃতিচর্চার নামে পরের বৌদের সিডিউস করতে ওস্তাদ। অরুণাদির মৃত্যুর জন্য ওইই দায়ী। যা হয়েছে ভগবানের বিচারেই হয়েছে এখন ও নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই মঙ্গল। পুলিশকে আমি যা বলার বলেছি, আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু রিপিট দেম। ইন ফ্যাক্ট তুমি এসব কথা তুলবে জানলে আমি আসতামই না।'

'চন্দন প্লীজ!' ধরা গলায় এষা বলে উঠল। ওর ঠোঁট কাঁপছে, মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

'চন্দন তুই এভাবে কথা বলছিস কেন? আমরা তোর বন্ধু, তোদের হেল্প করতে চাই। কিন্তু তুই যা জানিস পুরোটা খুলে না বললে কি করি বল? তুই বুঝতে পারছিস এটা একটা সীরিয়াস অ্যালিগেশন? তাও আবার এমন একজনের ওপরে যাকে সবাই সম্মান করে, এবং যে সাংঘাতিকভাবে অসুস্থ।' সৌম্যা আহত গলায় বলল।

'সৌম্যা আমি আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তোরা আমায় মাপ কর, আমি খুব জোর ঘা খেয়েছি, আমাকে একটু সময় দে।'

'কি ব্যাপারে ঘা খেয়েছিস একটু বলবি?'

'না। খুলে আম আলোচনা করার বিষয় এটা নয়।' চন্দন এবার এষার দিকে ফিরল, 'এষা আমি কিন্তু আশা করেছিলাম যে তুমি আমাদের পারিবারিক ব্যাপারগুলোকে কনফিডেনশিয়াল রাখবে। বোঝাই যাচ্ছে তুমি রাখনি। আমাদের বোধহয় ম্যারেজ কাউনসেলারের সাথে আরেকবার বসা উচিত।'

এষা এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল। সৌম্যা, মিলি ওকে টেনে নিয়ে গেল অন্যদিকে। একটা ঝগড়া লেগে ওঠার আগেই চন্দন গ্লাসটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালো।

'আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে নাটক দেখাতে চাইনা। ভেবেছিলাম আগের দিনের মতো আড্ডা মারব কিন্তু তোমরা ঐ সুইসাইডাল লোকটা আর গডড্যামড বাড়িটা থেকে বেরোতে পারছ না। যখন পারবে তখন ইচ্ছে হলে ডেকো, কিন্তু তার আগে আড্ডা জমবে বলে মনে হয় না। এষা, আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি, তোমার ইচ্ছে হলে এসো।'

'তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস চন্দন।' সুপ্রতীকও এবার উঠে দাঁড়িয়েছে।

'তাই নাকি? তা কি জানতে চাও বলেই ফেলোনা। আমি সৌমিত্রকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছি কিনা। না, তবে দিইনি বলে এখন আমার আপশোষ হচ্ছে। আমি বাঙালি ভদ্রলোকের ছেলে, বেইমানি দেখলেও আমার মাথায় খুন চাপে না। শুধ রাগে, দুঃখে মাথাটা জ্বলতে থাকে। আমি বারে বসে রাম খাচ্ছিলাম, বিশ্বাস না হয় বারের লোকটা সাক্ষী আছে।'


শেয়ার করুন

0 Please Share a Your Opinion.: