Wednesday 26 February 2020

সাদা ডাইনির কুঠি (পর্ব-২) ভৌতিক গল্প

সাদা ডাইনির কুঠি (পর্ব-২) ভৌতিক গল্প


'আমার বাবা এইসব বীভৎস ব্যাপার ভালো লাগে না। সৌমিত্রদা ইতিহাসের লেকচারটা বন্ধ কর প্লীজ। রাত্তিরবেলা এইসব বিদঘুটে ভূতের কেত্তন না দেখলেই নয়?' এষার গলায় বেশ একটু বিরক্তি। 'এই যে মহিলা অ্যানি পামার, এই বাড়ির মালকিন, সত্যিই ডাইনি ছিল নাকি--পর পর তিন স্বামীকে খুন করেছিল?'

'আসলে পুরো গল্পটা শুনলে কিছু কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। সে যুগে মেয়েদের যৌন স্বাধীনতা জিনিসটা বরদাস্ত করা হতনা, অখ্রীষ্টান শয়তানি কারবার বলে লেবেল মেরে দেওয়াই দস্তুর ছিল।' সৌমিত্রদা বললেন। 'অ্যানির বাবা-মা ব্রিটিশ, ভাগ্য ফেরাতে হাইতি দ্বীপে এসেছিল, সেখানে দুজনেই ইয়েলো ফিভারে মারা যায়। ও ধাইমার কাছে বড়ো হয়, সে বুড়ি আবার ছিল প্ল্যানটেশনের এক নামকরা ভুডু প্রিস্টেস। অ্যানিকে সে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করেছিল, ইউরোপীয় সামাজিক শিক্ষার সঙ্গে ভুডু তন্ত্রমন্ত্রে তালিম দিতে ভোলেনি। শোনা যায় ১৮২০ সালে অ্যানি বেশ শাঁসালো কোনো ভদ্রলোক ধরে বিয়ে করার জন্য জ্যামাইকাতে হাজির হয়। সদ্য বড়লোক জ্যামাইকান ঔপনিবেশিক সমাজে তখন বিবাহযোগ্যা ইংরেজ তরুণীর বেজায় অভাব। কলোনির ভদ্রলোকেরা খুশিমতো দোআঁশলা পয়দা করতে পারেন কিন্তু সমাজে কলকে পেতে হলে কিংবা সম্পত্তি রেখে যাবার জন্য আইনমাফিক খাঁটি ইউরোপীয় রক্তের বৌ-বাচ্চা চাই। অ্যানি ছিল ছোটখাটো চেহারার এক রহস্যময়ী রূপসী, প্রথাগত গ্রুমিং আর সভ্যতার পালিশ ভেদ করে ফুটে বেরুত ওর আদিম আকর্ষণ। জন পামার নামে এক উঠতি বড়লোক ওর প্রেমে পাগল হয়ে গেল। এই যে দেখছো রোজ হল, এর চারপাশে তখন ছিল কয়েক হাজার একর জমি, দুশো ক্রীতদাস আর জনা পঞ্চাশ খাসচাকর, নায়েব, ওভারসিয়ার নিয়ে জন পামারের বিরাট প্ল্যানটেশান। বিয়ের বছরখানেকের মাথায় জন পামার রহস্যজনকভাবে মারা গেলেন, অ্যানি পামার এই বিরাট সম্পত্তির মালকিন হয়ে বসল, ততদিনে পুরো তল্লাটে রটে গেছে যে অ্যানি পামার আসলে ডাইনি, সেইই তুকতাক করে স্বামীকে খুন করেছে। তাতে অবশ্য বিয়ের বাজারে তার দর কমেনি। অ্যানি তারপর আরো দুবার বিয়ে করে এবং সেই দুই স্বামীও নাকি অল্পদিনের মধ্যেই মারা যায়। মহিলা তার বিরাট সম্পত্তি কড়া হাতে শাসন করত, নিষ্ঠুরতায় ও অন্যান্য দাসমালিকদের বহুগুণে ছাড়িয়ে গিয়েছিল নাকি। রোজ হলের চাকরবাকররা তাদের কর্তামাকে যমের মতো ভয় পেত। চাবুক মারা থেকে শুরু করে হাত পা কেটে দেওয়া কিংবা গুমঘরে আটকে রাখা, এসব তো নিয়মিত ছিলই, মাঝে মাঝে ভুডু অনুষ্ঠানে টাটকা রক্তের দরকার পড়লে, অ্যানি নাকি অবাধ্য দাসদাসীদের বাচ্চাগুলোকে তুলে আনত। মাঝরাত্তিরে শোনা যেত রক্ত জমানো চিৎকার। অ্যানির নাম হয়ে গেল রোজ হলের সাদা ডাইনি।

'অ্যানির সবচেয়ে ভয়ানক খেলা ছিল স্বাস্থ্যবান যুবক ক্রীতদাসদের নিয়ে, যাদের ও বেছে বেছে কিছুদিনের জন্য নিজের বিছানায় তুলতো। সাদা ডাইনির অস্বাভাবিক যৌনক্ষুধা মেটানোর পর সেই ক্রীতদাসদের কেউ আর খামারের কাজে ফিরতে দেখেনি, তারা সব নাকি রক্তাপ্লতায় মারা যেত। তাদের ভুতেরা এখনো এই মাঠে হানা দিয়ে ফিরছে, সুন্দরী মেয়ে দেখলেই—'

'ওরে বাবা, প্লীজ হোটেলে ফিরে চল!' এষার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। এতক্ষণে অন্ধকারও দানা বেঁধে উঠেছে, সাদা খামারবাড়িটার গায়ে লাল আর সবুজ রঙের আবছা আভা। ভূতের কাণ্ডকারখানা শুরু হল বলে, বাসভর্তি ট্যুরিস্ট হাজির হয়েছে তারা ব্যাচে ব্যাচে বাড়িটার ভেতর ঢুকবে। সৌমিত্রদাও গল্পটা প্রায় শেষ করে এনেছেন।

  'অ্যানি মাত্র ত্রিশ বছর বয়েসে তার শোবার ঘরে খুন হয়। টাকু নামে যে ক্রীতদাস তাকে খুন করেছিল সেও ছিল অ্যানির প্রেমিক এবং ভুডু গুণীন। হয়তো মন্ত্রবলেই সে বুঝে ফেলেছিল যে তার দিন শেষ হয়ে এসেছে। তাছাড়া টাকু ছিল কিছুটা বয়স্ক, তার নাকি একটি মেয়েও ছিল। হবি তো হ, সেই মেয়েরই স্বামীর দিকে পড়লো সাদা ডাইনির নজর। ছেলেটি ভালো, নতুন বৌকে খুব ভালোবাসে, তাকে ছেড়ে ডাইনির বিছানায় যেতে চায়নি। জানতে পেরে অ্যানি যাদুবিদ্যা প্রয়োগ করে, টাকুর মেয়েটাও এক সপ্তাহের মধ্যে শুকিয়ে বিছানার সাথে মিশে যায়। রাগে, দুঃখে পাগল হয়ে টাকু গোপন পথে অ্যানির ঘরে ঢোকে, তারপর বিছানাতেই তাকে গলা টিপে খুন করে। টাকুকে গুলি করে মারে এক ওভারসিয়ার, তার সঙ্গে সঙ্গেই সব ক্রীতদাসেরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। রোজ হলের এই বিদ্রোহটা হয়েছিল ১৮৩০ সালে, নথিপত্রে তার হদিশ পাওয়া যায়। বাকি গল্পটার কোনো ঠিকঠাক প্রমাণ নেই, সাদা ডাইনির কাণ্ডকারখানা হয়তো পুরোটাই যাদুবাস্তব। সেই আমলে লোকে এমনিতেই অল্পবয়েসে মারা যেত। জ্যামাইকা তখন গুণ্ডা বদমায়েশ আর জলদস্যুদের আড্ডা। সুন্দরী বড়লোক বিধবাকে ছিঁড়ে খাবার জন্য লোকের অভাব ছিল না। ইউরোপ আর আফ্রিকা দুজায়গাতেই ডাইনি নিয়ে লোকের অবসেশন আছে, কত মেয়েকে এই বদনাম নিয়ে মরতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। অ্যানির বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হয়তো ছিল ওর ওই ডাইনি বদনামটাকে আরো ভয়াবহ করে তোলা যাতে কেউ ওর দিকে নজর দিতে ভয় পায়। ওটাই হয়তো ছিল ওর এমপাওয়ারমেন্টের একমাত্র উপায়। সে যাই হোক অ্যানির কবর দেওয়া হয়েছিল বাড়ির পিছনের জমিতে, কিন্তু সে নাকি সাদা ঘোড়া আর চাবুক নিয়ে প্রতি রাতে এখনও তার সম্পত্তি টহল দিয়ে বাড়ায়। ১৯৭৭ সালে জন রলিন্স বলে এক ভদ্রলোক বাড়িটা কিনে নিয়ে মেরামত করান, রক স্টার জনি ক্যাশ এখানে কিছুদিন ছিল। সেই গানবাজনা আর পার্টির ঠেলাতেই কিনা কে জানে, এখানকার প্রেতাত্মারা বোধহয় একটু কমজোর হয়ে পড়েছে। তাও এখানে কেউ রাত কাটাতে চায়না। এখন এটা রিটজ-কার্লটন গ্রুপের হানাবাড়ি অন ডিসপ্লে, ভালোই রোজগারপাতি হয় কিন্তু ঠিক দশটার সময় চাবি বন্ধ, সব শুনশান। এখানে একটা আয়না আছে সেটায় নাকি এখনো অ্যানির ছবি দেখা যায়, অনেকে ফটোও তুলেছে। যাকগে অনেক বকবক হল, এবার চল, আমাদের ট্যুরের সময় গেছে।' এষা কিছুতেই যেতে রাজি হল না, ওর মেজাজ একেবারে খারাপ হয়ে আছে। অগত্যা চন্দনও থেকে গেল বাসের কাছে, বাকিরা গাইডের সাথে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। গা ছমছমে একটা পাথরে বাঁধানো কোর্টইয়ার্ড, তার মাঝখানে একটা আদ্যিকালের বার, সেখানে দু-একজন বসে রাম খাচ্ছে। চারদিকে দাসব্যবসায়ীদের যন্ত্রপাতি ঝোলানো, মরচে ধরা লোহার শেকল, চাবুক, তালাচাবি আর বিকট চেহারার জাঁতাকল, যেগুলো নাকি খামারের চারদিকে পাতা থাকত। দাসেরা পালাতে গিয়ে ভুল জায়গায় পা ফেললেই লোহার দাঁতে পা আটকে যাবে, তখন অ্যামপুট করে বার করা ছাড়া উপায় নেই। তারপর তাদের একটু একটু করে পচে মরার জন্য গুমঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। বারের পিছনেই সেই গুমঘরে ঢোকার গুপ্ত দরজা। দুদিকে ঘোরানো সিঁড়ি, উঠতে গেলে বিচ্ছিরি মচমচে আওয়াজ, ঝাড়লণ্ঠনগুলো টিমটিম করে জ্বলছে, ঘোলাটে আলো-আঁধারির মধ্যে বিদঘুটে রং করা দেওয়াল আর অয়েল পেন্টিং। ভুতের ট্যুরটার খুব ভালো কোরিওগ্রাফি, মাঝে মাঝেই সেকালের পোষাক পরা ক্রীতদাসদের দেখা যাচ্ছে, নড়ে উঠছে টেবিলচেয়ার, মেঝের ওপর ঘুরপাক খাচ্ছে কুয়াশা, পিলে চমকানো চিৎকার করে দৌড়ে পালাচ্ছে কারা যেন। ঘন্টাখানেকের ট্যুর শেষ হবে অ্যানির কবরে, সেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ধুপ করে একটা আওয়াজ হল, তারপর মাটির ওপর শেকল ছেঁচড়ে নিয়ে যাবার শব্দ। সৌম্যা ভুতটুত মানে না, কিন্তু ও অজান্তেই সঞ্জয়ের হাত ধরে ফেলেছে শক্ত করে।

'কি সৌমিত্রদা? থেকে যাবেন নাকি রাত্তিরে? মনে হচ্ছে ভূত দেখার এই সুবর্ণ সুযোগ। সৌমিত্রদা—' সঞ্জয় উত্তর না পেয়ে এদিক ওদিক তাকালো।

'আমি দেখলাম উনি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। নিচের মাঠে ওরা ভূত সেজে কিসব নাচগান করছিল।' সৌম্যা বলল।
'চল, বাসে ফেরার আগে ডেকে নেব। নির্ঘাৎ ওই ভৌতিক বারে বসে রাম টানছে।' সুপ্রতীকের কথা শেষ হতে না হতেই অন্ধকার চিরে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পেল সবাই। এষার গলা - 'হেল্প! প্লীজ হেল্প!!'

পাথরে বাঁধানো উঠোনের উপর ঘাড় গুঁজে পড়ে আছেন সৌমিত্রদা, একটা পা অস্বাভাবিকভাবে কোমর থেকে মুচড়ে রয়েছে, মাথাটা রক্তে মাখামাখি, দেখলেই বোঝা যায় মানুষটা উপরের বারান্দা থেকে পড়ে গেছে। এষার পুরো হিস্টেরিয়া, দাঁতে দাঁত লাগিয়ে গোঁ গোঁ করছে, চন্দন তাকে নিয়ে ব্যস্ত। ভূতের বাড়ির ম্যানেজার ছুটে এসেছেন। সৌমিত্র অজ্ঞান, কিন্তু তখনো বেঁচে আছেন। সঞ্জয় ওঁর মাথাটাকে সাপোর্ট দিয়ে, শ্বাস চালু রাখতে চেষ্টা করছে। এর মধ্যেই পুলিস আর অ্যাম্বুলেন্স হাজির হল, ঘন্টাখানেকের মাথায় ওরা সকলেই হাসপাতালে। ওদের ট্রিপ ইনসিওরেন্স করা আছে, একটু বাদেই রোগীকে মায়ামিতে এয়ার-লিফট করা হবে। ওদের ছুটি এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে।

'কি বলছিস সৌম্যা? লোকটা হাসপাতালে পড়ে আছে আর তোরা ওর বদনাম ছড়াচ্ছিস।'

'যা সত্যি তাই বলছি মিলিদি। সৌমিত্রদার সঙ্গে অরুণাদির সম্পর্ক খুব খারাপ হয়ে গেছিল, বেঁচে থাকলে অরুণাদি ওকে ডিভোর্স করত। আমাকে নিজে বলেছে, সৌমিত্রদার নাকি কি একটা অ্যাফেয়ার চলছিল। এষার সাথে।'

'এসব কথা এতদিন বাদে শুনছি কেন? এখন সৌমিত্রদা নিজেকে ডিফেণ্ড করতে পারবে না বলে?'

শেয়ার করুন

0 Please Share a Your Opinion.: